লেবানন খেলায় ধরা খেয়ে গেল সৌদি


সবার নজর জেরুজালেমের দিকে। লেবাননকে নিয়ে খেলতে গিয়ে সৌদি আরব যে বড় ধরনের ধরা খেয়েছে, তা অনেকটাই আড়ালে চলে গেছে।

প্রায় এক মাস আগে সৌদি আরবে গিয়ে আকস্মিকভাবে পদত্যাগের ঘোষণা দেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি। তাঁকে পদত্যাগে সৌদি আরব বাধ্য করেছিল বলে বহুল প্রচার রয়েছে।

সৌদি আরবের এই পদক্ষেপকে তার আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ ইরানকে দমানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই দেখা হয়। তবে এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে যা কিছু ঘটেছে, তা সৌদি আরবের জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে।

লেবাননে ফিরে সাদ হারিরি তাঁর পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন। দেশের স্বার্থে লেবাননের বিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে যায়। তারা সমঝোতায় আসে। সাদ হারিরিকে নিয়ে কয়েক সপ্তাহের অনিশ্চয়তার ইতি ঘটে।

লেবাননের মন্ত্রিসভা বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, বৈরুত কোনো আঞ্চলিক দলাদলি বা দ্বন্দ্বের মধ্যে নেই।

লেবাননের জাতীয় রাজনীতির এমন নাটকীয় মোড়ে রিয়াদের দাবার চাল পুরাই মাঠে মারা গেছে।

অনেক দিন ধরেই সাদ হারিরিকে সমর্থন দিয়ে আসছে সৌদি আরব। রিয়াদ আশায় ছিল, সাদ হারিরি সৌদি আরবের হয়ে তেহরানের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবেন; ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহকে মোকাবিলা করবেন।

রিয়াদ হোঁচট খায়। ২০১৬ সালে লেবাননে এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে জোট সরকার গঠিত হয়। সাদ হারিরি হন সরকারপ্রধান। তাঁর মন্ত্রিসভায় হিজবুল্লাহকেও রাখা হয়।

সাদ হারিরিকে দিয়ে হিজবুল্লাহকে বাগে আনার যে কৌশল সৌদি আরব নিয়েছিল, তা কাজে আসেনি। বরং ইরানপন্থী শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীটির প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়েই চলছে।

এতে স্পষ্টত রুষ্ট হয় রিয়াদ। এরই মধ্যে গত মাসের শুরুর দিকে সৌদি আরব যান সাদ হারিরি। সেখানে গিয়ে সবাইকে অবাক করে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি।

সাদ হারিরির ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সৌদি আরবে নেমে বোকা বনে যান। রিয়াদে অর্থনৈতিক প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হবে—এমনটাই ভেবেছিলেন তিনি।

কিন্তু তাঁর সামনে আসে অবরোধের তালিকা। লেবাননের ১ লাখ ৬০ হাজার কর্মীকে সৌদি আরব থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেয় সৌদি আরব। লেবানন থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারে আঞ্চলিক ব্যবসায়ীদের চাপ দেওয়া হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সৌদি আরবে বসেই পদত্যাগের ঘোষণা দেন সাদ হারিরি।

পদত্যাগের ঘোষণার পর প্রায় দুই সপ্তাহ রিয়াদে ছিলেন সাদ হারিরি। সৌদি আরবে তাঁর অবস্থান নিয়ে নানা গুজব ছড়ায়। তাঁকে বন্দী বা জিম্মি করে রাখা হয়েছিল বলেও কথিত আছে।

তবে এ প্রসঙ্গে লেবাননের প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রের ভাষ্য, সৌদি আরবে সাদ হারিরি আক্ষরিক অর্থে বন্দী ছিলেন না। কিন্তু সৌদি আরবের কর্তৃপক্ষ তাঁকে (সাদ হারিরি) বলেছিল, ‘তুমি যদি লেবাননে যাও, আমরা তোমাকে হিজবুল্লাহর লোক বলে ধরে নেব। আর তোমার সরকারকে আমাদের শত্রু ভেবে নেব।’

লেবাননকে কাতারের মতো শায়েস্তা করার হুমকিও রিয়াদ দিয়েছিল বলে সাদ হারিরির ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি।

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে প্রায় তিন সপ্তাহ পর বৈরুতে ফিরে আসেন সাদ হারিরি। প্রেসিডেন্ট মিশেল আউনের সঙ্গে বৈঠকের পর পদত্যাগের ঘোষণা স্থগিত করেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন।

৫ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে অংশ নেন। পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।

প্যারিসভিত্তিক ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফেয়ার্সের করিম বিতার মনে করেন, ইরানকে একটা শক্ত বার্তা দিতে চেয়েছিল সৌদি আরব। কিন্তু রিয়াদের পরিকল্পনা বুমেরাং হয়েছে।

সৌদি আরবে থাকাকালে সাদ হারিরি সংকট নিয়ে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বক্তব্য আসে। সাদ হারিরি প্রশ্নে এই দুই দেশের বক্তব্যে চাপে পড়ে সৌদি আরব। রিয়াদ ভেবেছিল, ‘তার তালেই ঘড়ির কাঁটা চলবে’।

কিন্তু বাস্তবে তেমনটি হয়নি; বরং বিপরীতই হয়েছে।

সাদ হারিরির দেশে ফেরার ব্যাপারে রিয়াদ একেবারেই নারাজ ছিল বলে একটি পশ্চিমা সূত্র জানায়। পরের ঘটনাবলি সম্পর্কে এই সূত্রের মন্তব্য, সাদ হারিরি এখন ফের লেবাননের প্রধানমন্ত্রী।

আর তাঁর মন্ত্রিসভায় হিজবুল্লাহ বহাল তবিয়তেই রয়ে গেছে।

ফ্রান্সের একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, সৌদি আরবের তরুণ যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বুঝতে পেরেছেন, লেবাননের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে তিনি একটু বেশিই খেলে ফেলেছেন। আর সেই সুবাদে সাদ হারিরি জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন।

সাদ হারিরির ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সৌদি আরব এখনো শেষ কথা বলেনি। লেবাননের ব্যাপারে সৌদি আরবের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

No comments

Powered by Blogger.