মহান আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত পানি

পানি জীবনের উৎস। পবিত্র কোরআনে এ বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে : ‘আর আমি তো পানি থেকে সব প্রাণবান বস্তুকে সৃষ্টি করেছি। ’ পানির সঙ্গে প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের সম্পর্কের কথা প্রকাশ পেয়েছে পবিত্র কোরআনের আরও কয়েকটি আয়াতে।
ইরশাদ করা হয়েছে : ‘তিনি তো আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তা তোমাদের জন্য পানীয়। এ থেকেই উদ্ভিদসমূহের জন্ম হয়। যেগুলোতে তোমরা পশুচারণ করে থাক। ’ (সুরা নাহল : আয়াত ১০)
দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে পানির বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে।

যে কারণে পবিত্র কোরআনের ৪৬ স্থানে পানির বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। সুরা আরাফের ৫০ নম্বর আয়াতে পানিকে জান্নাতবাসীর জন্য নেয়ামত এবং জাহান্নামিদের জন্য শাস্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পানিকে অতীতেও আল্লাহ অনুগত বান্দার জন্য পুরস্কার এবং অবাধ্যদের জন্য শাস্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং তাঁর পুণ্যবতী স্ত্রীর পুণ্যবান সন্তান ইসমাইল (আ.) এর জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল জমজম কূপ।
দুনিয়ায় আল্লাহ রব্বুল আলামিনের বিস্ময়কর নিদর্শনগুলোর মধ্যে জমজম কূপ অন্যতম। প্রায় ৫ হাজার বছর আগে অলৌকিকভাবে পবিত্র কাবা ঘরের সন্নিকটে এ বরকতময় কূপটির সৃষ্টি হয়। আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.) প্রিয়তমা স্ত্রী হাজেরা ও দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাইল (আ)-কে জনমানবহীন প্রান্তরে নির্বাসনে দেন। স্ত্রী ও পুত্রের জন্য সামান্য পানি ও কিছু খেজুর মক্কার মরু প্রান্তরে রেখে যান। ইব্রাহিম (আ.) চলে যাওয়ার পর হাজেরা (আ.) সন্তানকে বুকে ধারণ করে আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে নির্জন প্রান্তে থাকেন।
খাদ্য-পানীয় ছাড়া তিনি বেশ কিছু দিন কাটান। বুকের দুধ নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর ইসমাইল (আ.) যখন ক্ষুধায় কাতর হয়ে ছটফট করছিলেন, তখন হজরত হাজেরা (আ.) দুগ্ধপোষ্য শিশুর জীবন বাঁচানোর জন্য একবার সাফা পাহাড়ে আরেকবার মারওয়া পাহাড়ের ওপর ছোটাছুটি করেন পানির খোঁজে। কোথাও পানি না পেয়ে তিনি যখন ক্লান্ত শ্রান্ত তখন হঠাৎ দেখতে পান ইসমাইল (আ.)-এর পায়ের আঘাতে পানির ফোয়ারা উথলে উঠছে। চারদিকে তিনি বালু ও পাথর দিয়ে পানির প্রবাহ থামান। সেই কুদরতি পানির ঝরনা ধারাটিই জমজম কূপ।
একইভাবে হজরত নূহ (আ.) এর অবাধ্য কওমের জন্য নাজিল হয়েছিল শাস্তি হিসেবে ভয়াবহ প্লাবন। যে প্লাবনে অবিশ্বাসীদের সবাই পানিতে ডুবে মারা যায়। ফেরাউন ও তার সৈন্য দলের পানিতে ডুবে মারা যাওয়াও আল্লাহর তরফ থেকে আসা শাস্তি। দুনিয়াদারির জীবনে পানি এমন এক অপরিহার্য জিনিস যা ছাড়া জীবনধারণের কথা কল্পনা করাও কঠিন। পানি ইবাদতেরও অন্যতম অনুষঙ্গ। আল্লাহর ইবাদতের জন্য বান্দাকে পবিত্রতা অর্জন করতে হয়। পবিত্রতা অর্জনে পানির ব্যবহার সুবিদিত। মানবজীবনেই শুধু নয়, পৃথিবীতে জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে পানির অবদান অনস্বীকার্য।

আখিরাতের জীবনে পানি জান্নাতবাসীকে উপহার দেওয়া হবে ও জাহান্নামবাসীকে শাস্তি হিসেবে পানি থেকে দূরে রাখা হবে। জাহান্নামবাসী ভয়াবহ কষ্টে পানির পিপাসায় পড়ে জান্নাতিদের কাছে পানি চাইবে, কিন্তু তাদের পানি দেওয়া হবে না। আল্লাহ বলেন, ‘জাহান্নামবাসী জান্নাতবাসীকে ডেকে বলবে, আমাদের ওপর কিছু পানি বা খাদ্য ফেলে দাও বা আল্লাহ তোমাদের যা দিয়েছেন তা থেকে, তারা বলবে আল্লাহ এ দুটি অবিশ্বাসীদের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন। ’ (সুরা আরাফ, আয়াত ৫০)। পানি বর্তমান বিশ্বে ব্যাপকভাবে অপচয় হচ্ছে। পানি যেহেতু আমাদের জন্য বিশাল এক নেয়ামত সেহেতু মহান আল্লাহ পানির অপচয় করা নিষেধ করেছেন। পানির অপচয় ইসলামের দৃষ্টিতে এক মারাত্মক গর্হিত কাজ। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আহার কর ও পান কর কিন্তু অপচয় কর না, তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। ’ (সুরা আরাফ, আয়াত ৩১)।

ইসলামে পানির সদ্ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পানি যেহেতু মহান আল্লাহর নেয়ামত, সেহেতু পানির সংরক্ষণ এবং এর সদ্ব্যবহার মুমিনদের জন্য অবশ্য পালনীয়। এমনকি অজু করার সময়ও যাতে পানির অপচয় না হয় সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ইবনে মাজাহ শরিফের হাদিসে বলা হয়েছে : ‘সাহাবি হজরত সাদ বিন আবু ওয়াক্কাস (রা.) একদিন বসে অজু করছিলেন। এমন সময় রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার পানির ব্যবহার দেখে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এত অপচয় কেন? সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন অজুর মধ্যে কি অপচয় হয়? রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। এমনকি নদীর পাশে বসেও অজু করার সময় (পানি অযথা খরচ করলে অপচয় হিসেবে গোনাহ হবে)।

পানি কীভাবে পান করতে হবে সেই আদব মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন। বসে ডান হাত দিয়ে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে পানি পান করা সুন্নত। তিন শ্বাসে পানি পান করা উত্তম। রসুল (সা.) পানি সম্পর্কে যে শিক্ষা দিয়েছেন সেগুলো শুধু সুন্নত নয়, বরং এর প্রতিটিতে রয়েছে শরীর সুস্থ রাখার নিদর্শন। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পানির পাত্র ঢেকে রাখ এবং বাসনগুলো উল্টে রাখ। ’ (মুসলিম)।

আল্লাহ আমাদের পানির সদ্ব্যবহারের তৌফিক দান করুন।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট, কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ

No comments

Powered by Blogger.